অলৌকিক আরোগ্যের সাক্ষ্য: মৃত্যুর হাত থেকে উপাসনার আনন্দে যাত্রা
- Dilip Jana

- Jun 9
- 4 min read
জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যা আমাদের সমস্ত কিছু ভেঙে চুরমার করে দেয় — যখন সময় থেমে যায় বলে মনে হয়, আর চারপাশের দুনিয়াটা অন্ধকারে ডুবে যায় ভয় আর অনিশ্চয়তায়। আমাদের মণ্ডলী পরিবারের জন্য, ২০২৪ সালে ঠিক তেমনই এক মুহূর্ত এসেছিল — এক ভয়াবহ বিপর্যয়, যা কল্পনারও অতীত।
দুর্ঘটনা: আতঙ্কে জমে যাওয়া এক মুহূর্ত
সাধারণ একটি সকাল ছিল, যেমন প্রতিদিন হয়। আমাদের ভাই এবং উপাসনায় ড্রাম বাজানো এক প্রাণবন্ত যুবক, যিনি জীবনে ও উপাসনায় পূর্ণ উৎসাহে ভরপুর, প্রতিদিনের মতোই সকাল ৭টায় ব্যায়ামশালা গিয়েছিলেন এবং সকাল ১০টার দিকে তার রুটিন শেষ করে বেরিয়ে পড়েন। সেই সকালেও, বেলেঘাটা ক্রসিং-এর কাছের ব্যায়ামশালা থেকে বেরিয়ে ছিলেন — সেই একই ক্রসিং যেখানে তার জীবন চিরতরে বদলে যাবে।
তিনি সাইকেল চালিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সামনে অপেক্ষা করে থাকা বিপদের বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। হঠাৎ করে একটি প্রাইভেট বাস গর্জন করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটে আসে। কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তার দিকে বিপজ্জনকভাবে ঘুরে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বাসের ভারী চাকা তার দেহের উপর দিয়ে চলে যায় — ঠান্ডা, ভারী লোহার চাকা নির্মমভাবে তার মাংস ও হাড় চেপে ধরে।
চাকার ঘর্ষণের শব্দ ও ধাতব চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার বিভীষিকাময় আওয়াজ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। আশেপাশের লোকজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে, আতঙ্ক ও স্তব্ধতায় জমে যায় চারপাশ। তার সাহায্যের আকুতি ছিল দুর্বল, যেন শব্দের মাঝখানে হারিয়ে যাচ্ছে। কাছাকাছি থাকা স্বেচ্ছাসেবকরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন; কেউ একজন তড়িঘড়ি করে একটি অটোরিকশা নিয়ে আসে এবং ভয়ে ও আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে তাকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
হাসপাতালের দুঃস্বপ্ন: নীরবতা ও অবহেলার বিরুদ্ধে এক লড়াই
হাসপাতালে পৌঁছানোর পর, তার ভঙ্গুর দেহটি একটি বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যেখানে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু হওয়া উচিত ছিল, সেখানেই শুরু হয় এক দুঃস্বপ্নের অধ্যায়। পরপর পাঁচটি যন্ত্রণাময় ঘণ্টা — সে শুয়ে ছিল একা, নিরবিচারে অবহেলিত।
আমাদের মণ্ডলীর সদস্যরা যখন সেখানে পৌঁছান, তখন দেখতে পান — কেউ নেই তার পাশে, না কোনো সেবিকা, না কোনো চিকিৎসক। সে নিঃশব্দে ম্লান হয়ে যাচ্ছিল, নিঃশ্বাসে লড়াই করছিল — কারণ ডাক্তার ধর্মঘটের কারণে কোনো চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। হাসপাতালের স্টাফদের ঠান্ডা ভাষায় উত্তর ছিল,“আজও আমাদের কোনো ডাক্তার নেই, আগামী দিনগুলোর জন্যও নেই। এই রোগীর জন্য আমাদের কাছে ট্রমা কেয়ারও নেই।”
তখন আমাদের ভাইদের এবং বোনদের মনে একের পর এক প্রশ্ন জাগে —কিভাবে একজন গুরুতর আহত রোগীকে এমনভাবে ফেলে রাখা যায়?কেন তাকে এমন হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো যেখানে ট্রমা কেয়ারই নেই?কেন তাকে আরেকটি উপযুক্ত হাসপাতালে রেফার করা হলো না?
হাসপাতালের নীরবতা যেন আরও বেশি অসহ্য হয়ে উঠলো। অবশেষে, প্রচণ্ড চাপ ও প্রশ্নের মুখে পড়ে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে অন্য একটি হাসপাতালে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, সেই হাসপাতালেও একই অবস্থা — ডাক্তার ধর্মঘটের কারণে সেখানেও কোনো সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছিল না।
সময় কেবল এগিয়ে যাচ্ছিল — ধীরে ধীরে নিঃশেষ হচ্ছিল তার প্রাণশক্তি।নিঃসঙ্গতার, প্রতীক্ষার, ও অনিশ্চয়তার এক অসীম শূন্যতায় সে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে যাচ্ছিল।
অন্ধকারের দিনগুলো: মৃত্যুর সঙ্গে এক নির্মম সংগ্রাম
টানা তিনটি কঠিন দিন — সে এই দ্বিতীয় হাসপাতালে শুয়ে ছিল, দুর্বল, ভাঙাচোরা, প্রায় বিস্মৃতির কোলেই। শরীরের যন্ত্রণা ছিল প্রবল, কিন্তু আরও বেশি কষ্টদায়ক ছিল তার চিকিৎসার চারপাশের অসহায়তা। যন্ত্রগুলো ধীরে ধীরে শব্দ করছিল, হাসপাতালের জীবাণুমুক্ত গন্ধ যেন আরও গা ছমছমে করছিল চারপাশ।
আমাদের মণ্ডলীর পরিবার প্রহর গুনছিল — নিরন্তর প্রার্থনা করে যাচ্ছিল, দিনরাত থেমে থাকেনি সেই আর্জি। বিশ্বাসে অবিচল থেকে আমরা তাকে ঈশ্বরের সামনে তুলে ধরছিলাম, যেন আকাশ বিদীর্ণ করে সেই প্রার্থনার ধ্বনি পৌঁছায় সিংহাসনের কাছে।
প্রতীক্ষা ছিল অসহনীয়। প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি নিঃশ্বাস ছিল একেকটি যুদ্ধ। আমরা লড়েছি সন্দেহের সঙ্গে, ভয়ের সঙ্গে, ক্লান্তির সঙ্গে — কিন্তু আশার দ্বার কখনো বন্ধ করিনি।
আমাদের প্রার্থনা যেন সেই অন্ধকারে জ্বলে উঠা এক দুর্দান্ত শিখা — বিশ্বাসে দগ্ধ, ভালোবাসায় উদ্ভাসিত।

আশার এক ঝলক: অবশেষে চিকিৎসকরা উপস্থিত হলেন
দ্বিতীয় হাসপাতালে দুইটি কষ্টদায়ক দিন কাটানোর পর, এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এল। তার জামাইবাবু এসে উপস্থিত হলেন, এবং দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমরা তাকে আবারও স্থানান্তর করলাম — এমন এক হাসপাতালে যেখানে অবশেষে চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন।
অবশেষে, দক্ষ হাতগুলো তার ক্ষতিগ্রস্ত দেহের যত্ন নিতে শুরু করল, এমন সেবা দিতে যা সে এত তীব্রভাবে প্রয়োজন করছিল।
যদিও সামনে এখনও দীর্ঘ ও অনিশ্চিত পথ রয়ে গেছে, তবুও এই মুহূর্তটা ছিল প্রকৃত আরোগ্যের সূচনা।
প্রার্থনার শক্তি: আমাদের মণ্ডলীর পরিবারের অবিচল বিশ্বাস
এই কঠিন ও শঙ্কাময় যাত্রাপথে, আমাদের মণ্ডলীর পরিবার প্রার্থনায় দৃঢ় থেকে যায়। দিন-রাত নিরন্তর প্রার্থনা উঠে যেন সুগন্ধি ধূপের মতো, এক অবিচ্ছেদ্য বিশ্বাসের চেন হিসেবে আমাদের ভাইকে ঘিরে রাখে। আমরা সেই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থির রেখেছিলাম, যিনি আরোগ্য দেন, পুনর্নির্মাণ করেন, এবং যেখানে মৃত্যু রয়েছে সেখানে জীবন ফেরান। আমাদের হৃদয় আশা নিয়ে একত্রিত হয়, তাঁর প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে এবং তাঁর নিখুঁত সময়ের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখে।
বিপর্যয়ের উপর বিজয়: আনন্দে ভরা নতুন সূচনা
আজ, সেই একই ভাই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন — শুধু সুস্থ হয়েছেন তাই নয়, বরং পুরো অর্থেই জীবন্ত। তাঁর সুস্থতা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়, এটি ঈশ্বরের অবিচলিত প্রেম এবং ভাঙ্গা জিনিস পুনর্নির্মাণের ক্ষমতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
তিনি আর নির্জনে চুপচাপ বসে থাকেন না; এখন তিনি প্রাণবন্ত উদ্দীপনা ও অফুরন্ত আনন্দ নিয়ে উপাসনায় নেতৃত্ব দেন, যা পুরো স্থানটিকে আলোকিত করে তোলে। তাঁর ড্রামের প্রতিটি ছন্দ জীবনের বিজয়ের গান, যা মৃত্যুকে পরাজিত করেছে, আশা নিরাশাকে হারিয়েছে, এবং বিশ্বাস ভয়কে জয় করেছে।

তাঁর হাসি আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল, এবং তাঁর হৃদয় ভরে উঠেছে কৃতজ্ঞতায়, কারণ ঈশ্বর তাঁকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছেন দয়া করে। তাঁর গল্প একটি জীবন্ত উৎসব — একটি আনন্দময় স্মরণ যে যতই গভীর অন্ধকার হোক না কেন, ঈশ্বরের আলো চমকপ্রদ উজ্জ্বলতায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই যাত্রার মাধ্যমে আমরা সবাই স্মরণ করেছি যে, আরোগ্য, পুনরুদ্ধার এবং নতুন সূচনা সবসময় সম্ভব। যিনি ব্রহ্মাণ্ডকে তাঁর হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন, তিনি আমাদের প্রত্যেকের জীবনকেও ধরে রেখেছেন, সুন্দরতা ছাই থেকে এবং আনন্দ বেদনায় থেকে আনতে প্রস্তুত।
এই সাক্ষ্য একটি আশার প্রদীপ, যা তাদের জন্য উজ্জ্বল আলোকিত যারা নিজেদের সংগ্রামের মুখোমুখি। এটি স্পষ্ট ও উঁচুস্বরে ঘোষণা করে: ঈশ্বরের করুণা কখনো ব্যর্থ হয় না, তাঁর শক্তি কখনো ফিকে হয় না, এবং তাঁর প্রেম সর্বদাই জয়ী হয়।
চলুন আমরা একসঙ্গে এই অলৌকিক ঘটনায় আনন্দিত হই এবং এর আনন্দময় বার্তাটি আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি — যে ঈশ্বরের সঙ্গে, প্রতিটি শেষ একটি মহিমান্বিত নতুন সূচনা হয়ে উঠতে পারে।

Comments